গণতন্ত্র: আমাদের ঈশ্বর
মুক্তিপ্রকাশ রায়
গণতন্ত্র জিনিসটা ভগবানের মতো। সবাই বিশ্বাস করে যে গণতন্ত্র আছে, অথচ কেউই তা চোখে দেখেনি। বিশ্বাস না করে উপায় কী? বিশ্বাসে মিলায় রাম/ আল্লা/যিশু, তর্কে ঢিশুম/চাপাতি/ ইনক্যুইজিশন। গণতন্ত্রেও অবিশ্বাসীদের জন্য বিভিন্ন দাওয়াই আছে।
অনেকেই অবশ্য দাবি করে -- তারা নাকি গণতন্ত্র চর্মচক্ষে দেখেছে, যেমন অনেক মহাসাধক/সাধিকা ভগবানের দর্শনলাভ করেছেন বলে শোনা যায়। এসব দাবি মিথ্যে নয়। তবে দুটো ব্যাপারই পরিস্থিতি-নির্ভর। ভক্তের ভরাপেট অবস্থায়, দিনদুপুরে, বাজারের মাঝখানে যেমন ভগবান দেখা দেন না; গণতন্ত্রও সারাবছর সর্বত্র দেখা যাওয়ার কথা নয়।
আপনি যদি তপস্যা করেন; অর্থাৎ খাওয়া-ঘুম ত্যাগ করে, গা-ছমছমে শ্মশান-টশানে বসে, দিনকয়েক ভগবানের নাম জপ করেন, খাদ্য-জল ইত্যাদির অভাবে শরীরে সোডিয়াম-পটাশিয়াম-ক্যালসিয়ামের অনুপাত ঘেঁটেঘুঁটে গিয়ে আপনি নানা অলৌকিকতা প্রত্যক্ষ করবেন এ-সম্ভাবনা বৈজ্ঞানিকেও মানতে বাধ্য। কোনও উপযুক্ত পরিবেশে, ধরা যাক কোনও জনহীন মিউজিয়ামে, ডাইনোসরের কঙ্কালের সামনে বসে একইভাবে ডাইনোসরের ধ্যান করলে তার দর্শনলাভও অসম্ভব নয়। গণতন্ত্রও সেইরকম। আপনার শহুরে অফিসের মিটিঙে, বা স্টাফরুমের মোড়ল-নির্বাচনে তার ঝলক দেখা গেছে বলে রাজনীতির সভয়ারণ্যেও যদি আপনি তার দর্শনপ্রত্যাশী হন, তাহলে আপনি আবালক।
রাজনীতি কথাটাই রাজতন্ত্র-ঘেঁষা। এবং রাজতন্ত্র খুবই সৎ এক শাসনপদ্ধতি। এখানে কোনও লুকোছাপার ব্যাপার নেই। যার ক্ষমতা আছে, সে সবার ওপর ছড়ি ঘোরাবে, ব্যস। খুবই যুক্তিসঙ্গত দাবি। জঙ্গলেও এই নিয়মই চলে। সেখানে জোর যার, মুলুক তার। যে শাসিত হয়, তার কাছেও ছবিটা পরিষ্কার। কেউ হরিণকে এটা অন্তত বোঝায় না যে বাঘ-সিংহের পেটে যাওয়ার ব্যাপারটা সে নিজেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে বেছে নিয়েছে। হরিণ জানে -- সে কী চায় তাতে কিস্যু যায় আসে না। সে দুর্বল। অতএব তাকে বাঘসিংহের দাদাগিরি সহ্য করেই বাঁচতে হবে। আমরাও সমাজে ক্ষমতাবানদের সামনে নতজানু হয়েই বাঁচি। তফাত এই যে আমরা বোকার মতো ভেবে নিয়েছি-- এটা আমাদের যৌথ সিদ্ধান্ত, কেন-না আমাদের ভোটার কার্ড আছে।
রাজতন্ত্র আসলে ডোডোপাখি হয়ে যায়নি এখনও। গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে সে এখনও আমাদের পুতুলনাচের অদৃশ্য বাজিকর। গণতন্ত্র ব্যাপারটাই আসলে রাজতন্ত্রের সামান্য বিকেন্দ্রীকরণ। আগে একজন রাজা দেশ শাসন করতেন। এখন সেই ক্ষমতা বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর ওপর বর্তেছে। তবে ওই গায়ের জোরের ব্যাপারটা রয়েই গেছে। জোরটা খাটানো হয় চয়েস-কে বাধা দিয়ে নয়; বরং সব চয়েসকে হবসনস চয়েসে পরিণত করে।
আপনি জমিদারি ব্যবস্থার ওপর বিরক্ত; জমিদারি উচ্ছেদের পর গণতন্ত্রের জয়গান গাইতে গাইতে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে দেখলেন যে পাঁচজন প্রাক্তন জমিদারের মধ্য থেকেই একজনকে বাছতে আপনি বাধ্য। হয়ে গেল সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন, কেমন? 'ফ্রিডম' নামের এক প্রবন্ধে জর্জ বার্নার্ড শ গণতন্ত্রের এই পরিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
লাল আর নীল জামার মধ্যেই যদি একটা বাছতে হয় আপনাকে, তাহলে আপনি চাইলেও হলুদ জামা বাছার সুযোগ পাচ্ছেন না। তাহলে আপনার পছন্দের আর মূল্য কোথায়? ভোটে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় যে বোমা, গুলি ইত্যাদি চলে তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা ইতিহাসের পরম্পরা। আপনার পছন্দকে প্রহসনে পরিণত করাই এর উদ্দেশ্য। যার ক্ষমতা আছে, সে অতীতে রাজতন্ত্রের লড়াইয়ে যেমন জিতেছে, আজ গণতন্ত্রের খেলাতেও সে জিতবে। ফাউল করে হলেও জিতবে। কাউকে নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না দিয়ে সে প্রমাণ করবে সে-ই সবার একমাত্র পছন্দ।
তাই আমি শুরুতেই বলেছি আমার সংশয়ের কথা। গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তা সম্ভবত বাস্তবে নেই। ধনতন্ত্র আছে, কেন-না পয়সাওয়ালা লোকজন রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পনসর করে; তাই যাবতীয় নীতি তাদের মুখ চেয়েই নির্ধারিত হয়। Gun-তন্ত্রও আছে। বন্দুকের নল আর ক্ষমতাদখলের কৌশল খুবই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তবে গণতন্ত্র সম্ভবত সংবিধানের দু-মলাটের বাইরে এখনও বেরোতে পারেনি।
আর গণতন্ত্র বোধহয় খুব একটা যুক্তিসংগতও নয়। কেন সবার মতামতের দাম সমান হবে বলুন তো? অমর্ত্য সেন আর পাড়ার গোবরা মস্তান -- দুজনের বোধবুদ্ধি কি এক? অথচ গণতন্ত্রে দুজনেরই মতের সমান দাম; দুজনের একটা করেই ভোট! আমরা সব ব্যাপারে এক্সপার্ট ওপিনিয়নে বিশ্বাসী। কানের সমস্যায় কেউ চোখের ডাক্তারের মতামত জানতে চায় না। তাহলে দেশ চালানোর মতো একটা সিরিয়াস ব্যাপারে সবাই মতামত দেবেই বা কেন?
আবার নিজের মত-ও কি আসলে নিজের মত? কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ঘটনাটা শুনেছেন নিশ্চয়ই। এইধরনের সংস্থা ফেসবুক-জাতীয় সোশাল নেটওয়ার্ক থেকে আপনার মতামত-সংক্রান্ত তথ্য চুরি করে। তারপর কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের থেকে টাকা খেয়ে তাদের সপক্ষে এবং বিরোধীদের বিপক্ষে আপনার ওপর ভুলভাল তথ্যাক্রমণ শুরু করে। ফলত ভোটের দিন আপনার প্রোগ্রামড আঙুল ইভিএম-এ নির্দিষ্ট দলের বোতামের দিকে এগিয়ে যায়।
ভিতর থেকে আপনার অগোচরে আপনাকে এইভাবে চালিত করে যে-শক্তি, তাকেই সম্প্রতি আমেরিকা চিনেছে 'ডোনাল্ড ট্রাম্প' নামে। ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এই শক্তিরই নাম 'ঈশ্বর'।
আমার কাছে, বিশেষত ভোটের আগে, 'গণতন্ত্র'।
#মুক্তিপ্রকাশরায়
মুক্তিপ্রকাশ রায়
গণতন্ত্র জিনিসটা ভগবানের মতো। সবাই বিশ্বাস করে যে গণতন্ত্র আছে, অথচ কেউই তা চোখে দেখেনি। বিশ্বাস না করে উপায় কী? বিশ্বাসে মিলায় রাম/ আল্লা/যিশু, তর্কে ঢিশুম/চাপাতি/ ইনক্যুইজিশন। গণতন্ত্রেও অবিশ্বাসীদের জন্য বিভিন্ন দাওয়াই আছে।
অনেকেই অবশ্য দাবি করে -- তারা নাকি গণতন্ত্র চর্মচক্ষে দেখেছে, যেমন অনেক মহাসাধক/সাধিকা ভগবানের দর্শনলাভ করেছেন বলে শোনা যায়। এসব দাবি মিথ্যে নয়। তবে দুটো ব্যাপারই পরিস্থিতি-নির্ভর। ভক্তের ভরাপেট অবস্থায়, দিনদুপুরে, বাজারের মাঝখানে যেমন ভগবান দেখা দেন না; গণতন্ত্রও সারাবছর সর্বত্র দেখা যাওয়ার কথা নয়।
আপনি যদি তপস্যা করেন; অর্থাৎ খাওয়া-ঘুম ত্যাগ করে, গা-ছমছমে শ্মশান-টশানে বসে, দিনকয়েক ভগবানের নাম জপ করেন, খাদ্য-জল ইত্যাদির অভাবে শরীরে সোডিয়াম-পটাশিয়াম-ক্যালসিয়ামের অনুপাত ঘেঁটেঘুঁটে গিয়ে আপনি নানা অলৌকিকতা প্রত্যক্ষ করবেন এ-সম্ভাবনা বৈজ্ঞানিকেও মানতে বাধ্য। কোনও উপযুক্ত পরিবেশে, ধরা যাক কোনও জনহীন মিউজিয়ামে, ডাইনোসরের কঙ্কালের সামনে বসে একইভাবে ডাইনোসরের ধ্যান করলে তার দর্শনলাভও অসম্ভব নয়। গণতন্ত্রও সেইরকম। আপনার শহুরে অফিসের মিটিঙে, বা স্টাফরুমের মোড়ল-নির্বাচনে তার ঝলক দেখা গেছে বলে রাজনীতির সভয়ারণ্যেও যদি আপনি তার দর্শনপ্রত্যাশী হন, তাহলে আপনি আবালক।
রাজনীতি কথাটাই রাজতন্ত্র-ঘেঁষা। এবং রাজতন্ত্র খুবই সৎ এক শাসনপদ্ধতি। এখানে কোনও লুকোছাপার ব্যাপার নেই। যার ক্ষমতা আছে, সে সবার ওপর ছড়ি ঘোরাবে, ব্যস। খুবই যুক্তিসঙ্গত দাবি। জঙ্গলেও এই নিয়মই চলে। সেখানে জোর যার, মুলুক তার। যে শাসিত হয়, তার কাছেও ছবিটা পরিষ্কার। কেউ হরিণকে এটা অন্তত বোঝায় না যে বাঘ-সিংহের পেটে যাওয়ার ব্যাপারটা সে নিজেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে বেছে নিয়েছে। হরিণ জানে -- সে কী চায় তাতে কিস্যু যায় আসে না। সে দুর্বল। অতএব তাকে বাঘসিংহের দাদাগিরি সহ্য করেই বাঁচতে হবে। আমরাও সমাজে ক্ষমতাবানদের সামনে নতজানু হয়েই বাঁচি। তফাত এই যে আমরা বোকার মতো ভেবে নিয়েছি-- এটা আমাদের যৌথ সিদ্ধান্ত, কেন-না আমাদের ভোটার কার্ড আছে।
রাজতন্ত্র আসলে ডোডোপাখি হয়ে যায়নি এখনও। গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে সে এখনও আমাদের পুতুলনাচের অদৃশ্য বাজিকর। গণতন্ত্র ব্যাপারটাই আসলে রাজতন্ত্রের সামান্য বিকেন্দ্রীকরণ। আগে একজন রাজা দেশ শাসন করতেন। এখন সেই ক্ষমতা বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর ওপর বর্তেছে। তবে ওই গায়ের জোরের ব্যাপারটা রয়েই গেছে। জোরটা খাটানো হয় চয়েস-কে বাধা দিয়ে নয়; বরং সব চয়েসকে হবসনস চয়েসে পরিণত করে।
আপনি জমিদারি ব্যবস্থার ওপর বিরক্ত; জমিদারি উচ্ছেদের পর গণতন্ত্রের জয়গান গাইতে গাইতে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে দেখলেন যে পাঁচজন প্রাক্তন জমিদারের মধ্য থেকেই একজনকে বাছতে আপনি বাধ্য। হয়ে গেল সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন, কেমন? 'ফ্রিডম' নামের এক প্রবন্ধে জর্জ বার্নার্ড শ গণতন্ত্রের এই পরিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
লাল আর নীল জামার মধ্যেই যদি একটা বাছতে হয় আপনাকে, তাহলে আপনি চাইলেও হলুদ জামা বাছার সুযোগ পাচ্ছেন না। তাহলে আপনার পছন্দের আর মূল্য কোথায়? ভোটে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় যে বোমা, গুলি ইত্যাদি চলে তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা ইতিহাসের পরম্পরা। আপনার পছন্দকে প্রহসনে পরিণত করাই এর উদ্দেশ্য। যার ক্ষমতা আছে, সে অতীতে রাজতন্ত্রের লড়াইয়ে যেমন জিতেছে, আজ গণতন্ত্রের খেলাতেও সে জিতবে। ফাউল করে হলেও জিতবে। কাউকে নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না দিয়ে সে প্রমাণ করবে সে-ই সবার একমাত্র পছন্দ।
তাই আমি শুরুতেই বলেছি আমার সংশয়ের কথা। গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তা সম্ভবত বাস্তবে নেই। ধনতন্ত্র আছে, কেন-না পয়সাওয়ালা লোকজন রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পনসর করে; তাই যাবতীয় নীতি তাদের মুখ চেয়েই নির্ধারিত হয়। Gun-তন্ত্রও আছে। বন্দুকের নল আর ক্ষমতাদখলের কৌশল খুবই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তবে গণতন্ত্র সম্ভবত সংবিধানের দু-মলাটের বাইরে এখনও বেরোতে পারেনি।
আর গণতন্ত্র বোধহয় খুব একটা যুক্তিসংগতও নয়। কেন সবার মতামতের দাম সমান হবে বলুন তো? অমর্ত্য সেন আর পাড়ার গোবরা মস্তান -- দুজনের বোধবুদ্ধি কি এক? অথচ গণতন্ত্রে দুজনেরই মতের সমান দাম; দুজনের একটা করেই ভোট! আমরা সব ব্যাপারে এক্সপার্ট ওপিনিয়নে বিশ্বাসী। কানের সমস্যায় কেউ চোখের ডাক্তারের মতামত জানতে চায় না। তাহলে দেশ চালানোর মতো একটা সিরিয়াস ব্যাপারে সবাই মতামত দেবেই বা কেন?
আবার নিজের মত-ও কি আসলে নিজের মত? কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ঘটনাটা শুনেছেন নিশ্চয়ই। এইধরনের সংস্থা ফেসবুক-জাতীয় সোশাল নেটওয়ার্ক থেকে আপনার মতামত-সংক্রান্ত তথ্য চুরি করে। তারপর কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের থেকে টাকা খেয়ে তাদের সপক্ষে এবং বিরোধীদের বিপক্ষে আপনার ওপর ভুলভাল তথ্যাক্রমণ শুরু করে। ফলত ভোটের দিন আপনার প্রোগ্রামড আঙুল ইভিএম-এ নির্দিষ্ট দলের বোতামের দিকে এগিয়ে যায়।
ভিতর থেকে আপনার অগোচরে আপনাকে এইভাবে চালিত করে যে-শক্তি, তাকেই সম্প্রতি আমেরিকা চিনেছে 'ডোনাল্ড ট্রাম্প' নামে। ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এই শক্তিরই নাম 'ঈশ্বর'।
আমার কাছে, বিশেষত ভোটের আগে, 'গণতন্ত্র'।
#মুক্তিপ্রকাশরায়