ডিকনস্ট্রাকশন
মুক্তিপ্রকাশ রায়
তেরোই জানুয়ারি, দুহাজার। ডেটটা এখনও ভুলিনি দেখছি। একটা কাপের চা দুভাগে ভাগ করতে করতে বলেছিল প্রবাল -- মেয়েদের সিগনাল ক্যাচ করার চেয়ে ডিকনস্ট্রাকশন বোঝা সহজ।
তখন আমাদের সেকেন্ড ইয়ার চলছে স্কটিশে। আগেরদিন কান্তাদি-র থিয়োরিকণ্টকিত লেকচারটা পুরো ট্যান হয়ে গেছে।
অবশ্য অনেকে মনে করতে পারেন যে মেয়েদের বোঝা ইংলিশ অনার্সের জন্য খুব একটা জরুরি নয়, গায়নিকোলজি বা সাইকোলজি হলে তাও বা ভাবা যেত। তবে সাহিত্যে হৃদয়বেদনার জায়গা তো আছেই। হস্টেলের ভাষায় যাকে 'চুলকুনি' বলা হয়। তার ওপর আমরা দুজনেই মফসসলের আমদানি, তায় চিরকাল বয়েজ স্কুলের ছাত্র। মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার অভিজ্ঞতা রাহুল গান্ধির রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সমতুল্য হওয়ায় ছোঁকছোঁকানি বেশি; টিউশনে মফসসলি বান্ধবীদের থেকে টেস্ট পেপার চাইতে গেলেও গলা কেঁপে যেত, যেন কুপ্রস্তাব দিচ্ছি। পথেঘাটে পুংবন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেলে মেয়েগুলো বাড়ির লোকের কাছে দাবড়ানি খেত।
কলকাতার কলেজে ভরতি হতে এসে প্রথম দিনই মন একেবারে ফুরফুরে। কত্ত মেয়ে! তাদের পোশাক-আশাকে আলোহাওয়া চলাচলের কত-না ব্যবস্থা! মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারে আমি চাইতুম পোড়া দেশে একটা বিপ্লব আসুক। ক্লাস নাইন-টেন থেকেই আনন্দলোকের পাতা থেকে সিডাকটিকিট সংগ্রহ করতুম। তবে আমাদের ওদিককার মেয়েগুলো কেমন যেন! একটু পিছিয়ে-পড়া টাইপ। অ্যাদ্দিনে যেন খরা কাটল। স্কটিশের মেয়েগুলোকে দেখে বাবা পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে গেল, দুনিয়া কত এগিয়ে গেছে!
অনেক ফ্যান্টাসি নিয়ে তো ভরতি হওয়া গেল। ও মা! ক্লাস করতে গিয়ে দেখি মিনি স্কার্ট পরা মেয়েগুলো সব ভ্যানিশ! বেশিরভাগ মেয়েই সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে, কয়েকজন শাড়িও।
যাক্কলা! সেই মেয়েটা গেল কোথায় যে শার্টটা জিনসের প্যান্টের বেশকিছুটা ওপরে গিঁট দিয়ে পরেছিল? ভেবেছিলুম ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের মেয়েগুলো একটু বেশিই খুল্লমখুল্লা হবে, যেমন বাংলা সিনেমার চেয়ে ইংলিশ সিনেমায় ইয়েটিয়ে একটু বেশি থাকে। কোথায় কী? ভুল করে অন্য কোনও ডিপার্টমেন্টে ঢুকে পড়িনি তো? ইত্যাকার সাতপাঁচ ভাবতেভাবতে ফ্রাস্টু খেয়ে লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়েছিলাম। সেখানে আশুতোষ রানার মতো বড়ো বড়ো চোখ নিয়ে গম্ভীরভাবে সমস্ত ক্লাসটাকে আমারই মতো জরিপ করছিল আর একজন। এভাবেই আমার প্রবালের সঙ্গে আলাপ।
অলিভাকে শেষপর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল ইতিহাসের ক্লাসে। আমার আর প্রবালের অন্যতম পাস-সাবজেক্ট ছিল ইতিহাস। পছন্দের বিষয়টি যে এতটা উত্তেজক হবে তা আগে বুঝিনি। অলিভা সেদিন অবশ্য শার্টে গিঁট দিয়ে আসেনি। লাল স্যান্ডো গেঞ্জিটাইপের জামা পরেছিল একটা। সামনের কাট-টা গভীর হওয়ায় ইতিহাস ক্লাসেও ভূগোলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। গলা থেকে হারের লকেট হিসেবে ঝুলছিল একটা ক্রিস্টাল বল, যা স্তূপ পর্বত আর গ্রস্ত উপত্যকার ওপর গড়ানে পেন্ডুলামের মতো যাতায়াত করছিল।
কিন্তু ধন্যি বিশ্বদেববাবুর কনসেন্ট্রেশন। এইসব লোক তপস্যা করলে মেনকা-টেনকাও ধ্যান ভাঙাতে এসে ফেল মারত। চোখের সামনে ওইরকম দৃশ্য দেখেও এতটুকু বিচলিত না হয়ে পড়িয়ে চললেন। স্কটিশে পড়িয়ে পড়িয়ে ওনার চোখে সব ক্লিভেজই পিয়োর ভেজ হয়ে গেছে ততদিনে।
তো বিশ্বদেববাবু বোঝাচ্ছিলেন, আজকাল ইতিহাস নিয়েও চ্যাংড়ামি শুরু হয়েছে। ইতিহাসও নাকি বয়ান আর বিরুদ্ধ বয়ানের দ্বন্দ্ব। অবিসংবাদিত সত্য বলে নাকি কিছু নেই। দেরিদাকে উদ্দেশ করে বললেন (যদিও দেরিদা সেদিন ক্লাসে অনুপস্থিত)-- বক্তব্যমাত্রেই যদি ধোঁয়াটে হয়, তাহলে তুই বাজার করিস কী করে শুনি? আটা চাইলে দোকানদার কি তোকে ডাঁটা দেয়? যত্ত সব!
এইসব হ্যালুমার্কা লেকচার শুনে প্রবালের মাথা কিঞ্চিৎ ঘেঁটে গিয়ে থাকবে। নয়তো ক্লাস শেষ হওয়ার পর আলাপ জমাতে গিয়ে খামোখা অলিভাকে বলতে যাবে কেন -- ভূগোল আমার খুব প্রিয় সাবজেক্ট, তোমার?
ভূগোল মানে? --স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল অলিভা --এটা তো হিস্টরি ক্লাস ছিল!
এই দুর্ঘটনার পর নিউ বসন্ত কেবিনে চা খেতে খেতে আমরা ডিসাইড করেছিলুম -- এইসব ট্যাঁশ মেয়ের সঙ্গে আর আগ বাড়িয়ে কথা নয়। আমাদেরও তো একটা প্রেসটিজ আছে, না কি? কদিন আগে ডিপার্টমেন্টের অনিন্দিতা মুখের ওপর প্রবালকে বলেছিল -- তোকে না একদম হিন্দি সিনেমার ভিলেনদের মতো দেখতে! আমাকে হয়তো জনি লিভার-টিভার বলে। এরা নিজেদের ভাবেটা কী? ওয়েন্ডি ফিটজউইলিয়াম? তাও যদি সুন্দরীরা বোকা না হত!
এরপর আমরা ইতিহাসের ক্লাসে ইতিহাসেই মন দেওয়ার চেষ্টা করি। বিশ্বদেববাবু পড়িয়ে চলেন ঐতিহাসিকদের মতভেদ। বয়ান আর বিরুদ্ধ বয়ানের মাঝে দুলতে থাকে ক্রিস্টাল বল। আমরা কেউ আর ক্রিস্টাল বলে নিজের ভাগ্য খোঁজার চেষ্টা করি না। দেখতে দেখতে কলকাতায় গরম কমে আসে। অলিভার সঙ্গে, অন্যান্য বন্ধুর মতোই, কথাবার্তা-হাসিঠাট্টা শুরু হয়। সবই ক্যাজুয়াল কথাবার্তা। এমনকি দু-একবার আমি, প্রবাল আর কয়েকটা মেয়ে একসঙ্গে সিনেমাও দেখতে গেলুম। দলে অলিভাও ছিল। সিনেমা হলের আলো-আঁধারিতে প্রবালের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও, আমার মতো, সিনেমাই দেখছে।
সেই অলিভা যে আমায় এত কাছের মনে করে তা আগে বুঝিনি। নইলে এত লোকের এত ভাট বকার মধ্যে কবে একবার বলেছিলুম --আমার ব্লাড গ্রুপ এবি নেগেটিভ-- সেটা মনে রাখে? বাগবাজারের বাড়ি থেকে একদিন কাঁদতে কাঁদতে সাতসকালে ওয়্যান হস্টেলে এসে হাজির, বাবাকে রক্ত দিতে হবে। ওর বাবার আর আমার একই গ্রুপ। নিজের মধ্যে যে এতবড়ো একটা সম্পদ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি, তা আগে জানা ছিল না। মনে হল এ-ডাক নিয়তির ডাক। মনে হল, নেতাজিই যেন আবার ডাক দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত এবার রক্তের বদলে স্বাধীনতার চেয়েও বেটার অফার আছে। তড়িঘড়ি গোলপার্কে পৌঁছে অশোক ল্যাবোরেটরিতে দেওয়া গেল রক্ত। দেখলুম, অফারের ব্যাপারে খুব একটা ভুল করিনি। একঘর লোকের সামনে জড়িয়ে ধরে গালে চকাস করে একটা চুমু খেল অলিভা -- শিবু, ইউ আর আ ডার্লিং!
প্রবালের সঙ্গে নিউ বসন্ত কেবিনে চা খেতে গিয়ে রসিয়ে রসিয়ে সৌহাগ্যের গপ্পোটা করা গেল (সৌহাগ্য = হাগ পাওয়ার সৌভাগ্য)। তখনই প্রবালের দার্শনিক উক্তি: মেয়েদের সিগনাল ক্যাচ করার চেয়ে ডিকনস্ট্রাকশন বোঝা সহজ।
বাঙালির দার্শনিকতা হচ্ছে হেরে যাওয়ার একটা লক্ষণ। ওই কারণেই প্রেমে ল্যাং খেয়ে এত লোক হাবিজাবি কবিতা লেখে। আমি বেশ বুঝতে পারলুম -- প্রবাল আমাকে একটু হিংসে করছে। ওরও তো অলিভার দিকে একটু টাল ছিল! হিংসে না হলে কয়েকদিন ছাড়া ছাড়া কেউ বলে 'কী রে, সেদিনের পর তোদের আর হাগাহাগি হল?'
আমার অবশ্য একটু খারাপই লাগছিল। একই হস্টেলে থাকি। একসঙ্গে ওঠাবসা। অথচ একটা মেয়ের কিস মিস করে আমাদের বন্ধুত্বটাই ডিসমিস করে দিতে চাইছিল যেন প্রবাল। একদিন সহজ করার চেষ্টায় বললুম -- অলিভা ওর সঙ্গে আমায় বইমেলা যেতে বলছে।
- তো? আমাকে শোনাচ্ছিস কেন?
-'তো' মানে তুইও যাবি যদি চ। মজা হবে। আড্ডাটাড্ডা জমবে ভালো।
-পাগল? --হেসে বলল প্রবাল; পির্যামাস আর থিসবি-র মাঝে পাঁচিল হয়ে দাঁড়াতে আমি রাজি নই।
বইমেলার পথে বাসে মিডসামার নাইটস ড্রিমের কথা মনে পড়ছিল। নাটকটা অসাধারণ পড়িয়েছিলেন শবরীদি। প্রেম আর সম্পর্কের জটিলতা থেকে কতরকমের যে মজা তৈরি হয় নাটকটাতে! মাঝখানে তো আমার রীতিমতো কনফিউশন হত নামগুলো নিয়ে। কে যে কাকে ভালোবাসে -- সব যেত গুলিয়ে। বাসেই প্রথম অলিভা আমার হাত ধরেছিল।
কলকাতা বইমেলা এক আজব জায়গা। বই কত বিক্রি হয় জানি না, তবে বিরিয়ানির দোকান কোটিপতি হয়ে যাওয়ার কথা। লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নে আবার পাগলদের কদর বেশি। যে যত এলিয়েন-মার্কা হাবভাব নিয়ে থাকতে পারবে, সে তত হিট। পাবলিকের মনোযোগ টানার জন্য কেউ দাড়িতে রামধনু রং লাগিয়ে আসে, কেউ সারা গায়ে পোস্টার লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কেউ নামিবিয়ার বাচ্চাদের খাদ্যসমস্যা দূরীকরণের জন্য চাঁদা তোলে, কেউ প্রকাশ্যে গাঁজা টানে, কেউ গিটার নিয়ে ভালোভালো গানগুলো অভিনব সুরে গাইবার চেষ্টা করে। আমার এইসব দেখে মজা লাগে। তাই সেদিকেই হাঁটা লাগিয়েছিলুম, কিন্তু হাতে পড়ল টান। ও হরি! বাসে হাতটা অলিভা সেই যে ধরেছিল আর ছাড়েইনি! গোটা শরীর কেমন অবশ হয়ে গেল। ভাগ্যিস কলকাতায় পড়তে এসেছিলুম!
তুই সঙ্গে থাকলে আমার খুব ভরসা হয়-- আইসক্রিম খেতে খেতে বলল অলিভা-- তোকে পেয়ে আমার একটা ভাই না থাকার দুঃখটা কেটে গেল।
-ভাই? -- আইসক্রিম খেয়ে গলাটা কেমন যেন বুজে আসছিল আমার।
-ভাই নয়? দ্যাখ না , তোর রক্ত বইছে এখন বাপির শরীরে, সেই রক্ত আবার আমার শরীরেও। উই আর লাইক ব্লাড রিলেশনস নাও।
মনে হল-- আমি, আমার চারপাশ, পায়ের নীচের মাটি সব যেন গলে গলে পড়ছে, অলিভার আইসক্রিমটার মতো। এইচ-এস অবধি সায়েন্স ছিল আমার । তাই শেষ চেষ্টা করা গেল -- হিমোগ্লোবিনের আয়ু বেশি নয়, জানিস তো? আমার সেই রক্ত কি কাকুর শরীরে এখনও...
-হি হি হি, শিবু, তুই না! তোর মাথায় কিছু আসেও বটে।
গোটা আর্গুমেন্টটাই বইমেলার ধুলোচাপা পড়ে গেল।
আবার হাত ধরে টানল অলিভা, একটু ওইদিকে চল না!
আমি আর পায়ে জোর পাচ্ছিলুম না। গলার স্বরে আট-আনা ক্লান্তি আর আট-আনা বিরক্তি-- ওদিকে কী আবার?
-ওই যে ওরা ছবি আঁকছে, আর্ট কলেজের স্টুডেন্টরা, ওখানে চ না একবার।
-ছবি আঁকাবি নিজের? আমার কিন্তু পোজটোজ দেওয়ার ধৈর্য নেই।
নিজের ছবি নয়, মাথা নিচু করে লাজুক হাসল অলিভা, আশুতোষ রানা-র ছবি এঁকে দিতে বলব একটা। বেডরুমে রাখব।
-আশুতোষ রানা? -- আমার তখন চোখমুখ হিংসেয় সবুজ।
-তুই দেখেছিস তো ওর অভিনয়? ভালো না? বল? আমার তো জাস্ট ফাটাফাটি লাগে।