Sunday, October 29, 2017

তিরিশে অক্টোবর, ২০১৭

তিরিশে অক্টোবর, ২০১৭
মুক্তিপ্রকাশ রায়

(সুকুমার রায়-এর জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ‍্য)

মিলছে না তাল, লাগছে না সুর
জীবনযাপন গম্ভীর
মন্ত্র নেব পাগলা দাশুর
দেখব কোথায় কম ভিড়
কানের কাছে জীবন যেন
ভীষ্মলোচন শর্মা
সুর মিলিয়ে দে বাগদেবী
একটু দয়া কর মা!
বাড়ছে ভুঁড়ি, দেখলে মরে
কুমড়োপটাশ লজ্জায়
কাঠবুড়োরা ডিগ্রি বেচে
অ্যাকাডেমির দরজায়
পেঁচার মতো অন্ধ আইন
রাত করে চোর দিনকে
সব হেশোরাম স‍্যালুট মারে
শ্রী ব‍্যাকরণ সিংকে
রুমাল থেকে বেড়াল হলে
কে করে লেজ কর্তন
"ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না"
বলছে পরিবর্তন

Thursday, October 26, 2017

বিদ্বজ্জন

বিদ্বজ্জন
মুক্তিপ্রকাশ রায়

("ভবসাগরতারণকারণ হে"-গানটির তালে পড়তে অনুরোধ করি)

আমি ধরতে রাজি ওঁচা ব‍্যক্তিরও পা
গুরু মানতে রাজি, যদি পাই শিরোপা
যদি পাউরুটি পাই, সাথে জ‍্যাম-ঝোলাগুড়
রাতকানা পেঁচাটিই যেন লক্ষ্মীঠাকুর
বুড়ো গাধাটি স্বয়ং লতা মঙ্গেশক‍র
কে যে কবিগুরু তুই তা এখন গেস কর
কাটা মুন্ডুকে বাঁধা রাখে রাজদরবার
সব পোষ‍্যরা খুশি, পেলে চিবোনোর হাড়
গজদন্ত মিনার চেপে আমরা ক'জন
ল‍্যাজ নাড়ি তবু লোকে ভাবে বিদ্বজ্জন

Saturday, October 21, 2017

সেই ছেলেটির গল্প

সেই ছেলেটির গল্প
মুক্তিপ্রকাশ রায়

ধুরন্ধর বিচক্ষণ বয়স তার উনিশ-বিশ
রাত দুটোয় জাল গোটায়, ভাইফোঁটায় আব্বুলিশ
পদ‍্য নয়, টোপ ছড়ায়; ঝোপ বুঝে পানপরাগ
ভঙ্গিতেও জঙ্গিভাব, সঙ্গী তার জুকারবার্গ
সকাল তার শঙ্খদার, বিকাল তার নন্দনেই
গোঁসাইজির বাগানটির ফুলতোলাও বন্ধ নেই
শক্তিমান, ভক্তিমান, যখন চান এনজিও
সুবোদ্ধা মিস করেন, কিস করেন সেনদিও
এইপাড়ায় সাব-অল্টার্ন, ওইপাড়ায় দামিও সে
একটু ভয় সে-ই আমি, একটু ভয় আমিও সে

Friday, October 20, 2017

সুযোগ: অক্টোবর ২০১৭

সুযোগ: অক্টোবর ২০১৭
মুক্তিপ্রকাশ রায়

এসব আসলে কিছু নয়
অকাজের কিছুটা সময়
নিজেরই পকেট কেটে চুরি
পাঁচিলের জবাব হাতুড়ি

কিছু ফেনা, কিছু বুদ্বুদও
নদীর খেয়ালে উদ্ভূত
আতসবাজির মতো আলো
আমাদের ম‍্যাজিক শেখাল

আমাদের প্রেমে ও প্রমাদে
সহনে অথবা প্রতিবাদে
এসব আসলে কিছু নয়
সুযোগে উপচে যেতে হয়

Friday, October 13, 2017

আধুনিক

আধুনিক
মুক্তিপ্রকাশ রায়

একসময়ে ফোঁস ছিল খুব
এখন সবই অলীক
সময় যেন তেজের ফণায়
ঢেলেছে কার্বলিক
আয়না এখন ভেংচি কাটে
বায়না তবু অটল
বস ভেবেছে কুকুর, শ্বশুর --
প্লেটো, অ্যারিসটোটল
বন্ধুনেতা ছোঁ মেরে খায়
যেমন শকুন, কি চিল
এক রাজা যায়, আরেক আসে
এক রয়ে যায় মিছিল
আমার শুধু ক‍্যালি -- ছড়ায়
মিল দিয়েছি খেটে
সমালোচক ভাবেন পাছে
নিতান্ত ব‍্যাকডেটেড

Friday, October 6, 2017

কবিতার জন্ম

কবিতার জন্ম
মুক্তিপ্রকাশ রায়

কথাগুলো উবে যায় কথোপকথনে

শব্দেরা হালকা হয়ে
গ‍্যাসবেলুনের মতো উড়ে যায় ভুল ঠিকানায়

গেরস্থালি ধৈর্য নিয়ে
একা-থাকা পেতে রাখে কেউ
ঘরোয়া দইয়ের মতো না-বলা কথারা
জমাট কবিতা হয়ে ওঠে

নীরবতা কবিতার জন্ম দেয় বলে
ঘুমন্ত শিশুর চেয়ে সফল কবিতা
          আজও কেউ লিখতে পারেনি

মায়ের কথা মনে পড়লে (৩)

মায়ের কথা মনে পড়লে (৩)
মুক্তিপ্রকাশ রায়

সকালের চা-টা আমার মায়ের সঙ্গেই খাওয়া অভ‍্যেস। অন্তত কয়েকমাস আগে অবধি এই রুটিনের নড়চড় হয়নি। বউও একটু জেলাস হত কি না কে-জানে! কপট রাগ দেখিয়ে মা-ন‍্যাওটা ছেলেকে তুলে দিয়ে বলত, যাও মায়ের সঙ্গে চা খেতেখেতে আদিখ‍্যেতা করে এসো।
     সকালের চা খেতেখেতে গুনগুন করে গান গাইত মা, "পুছো না ক‍্যায়সে ম‍্যায়নে র‍্যায়েন বিতাই"। এটা নাকি আবার দিদিমার প্রিয় গান ছিল। মা কখনও তেমন প্রথাগতভাবে গান না শিখলেও বেশ সুরেই গাইত। অনেকে মায়ের গান বৈঠকি আড্ডায় শুনে বলেছে, বউদির গলা তো বেশ মিষ্টি! মা শুনে লজ্জা পেত। দিদিমার রেওয়াজি গলার কণামাত্রও নাকি মা পায়নি। মাসিমণি অনেকটা পেয়েছে। আসলে সকালে আমি যখন মায়ের পাশে বসে চা খেতাম, মা অলক্ষে গল্প করে নিত দিদিমার সঙ্গে। ওই গানটার মধ‍্যে দু'জনের দেখা হত। আমরা বাইরে থেকে কিছু বুঝতে পারতুম না।
     আজ বুঝতে পারি ওই চায়ের সঙ্গে ফেলে-আসা দিনগুলো মিশিয়ে অদ্ভুত গাঢ় এক লিকার তৈরি করত মা। তাই সবজায়গায় চা খেয়ে আমি সেরকম তৃপ্তি পাই না। চায়ের সঙ্গে 'টা'-হিসেবে কয়েকটা মুচমুচে অ্যানেকডোট আমার চাইই চাই।
     আমার গোটা সকাল জুড়ে থাকত মায়ের ছোটোবেলার গল্প, নানারকম ক‍্যাবলামোর গল্প, জেঠতুতো আর মামাতো দাদাদিদির গল্প। প্রচুর ডিটেইলস মনে রাখতে পারত মা। পরে পরীক্ষা করে দেখেছি, যাদের কেন্দ্র করে গল্প, তাদেরই বহু কথা মনে নেই। বিশেষ করে, কে কবে কার প্রেমে পড়েছিল, সেই গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলতে ভালোবাসত মা; আর গল্পের নায়ক বা নায়িকা, যাঁর এখন চুলে পাক ধরেছে, এ-হেন না-পাক গল্পকে প্রাণপণে অস্বীকার করতেন। আমাকে একান্তে এমন কথাও তাঁরা বলে গেছেন, তোর মায়ের মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে গেছে, ভালো সাইকায়াট্রিস্ট দেখা।
     আমারও বিপদ হয়নি তা নয়। আরামবাগের কোন ললনার ওপর কৈশোরে আমি কিঞ্চিৎ ক্রাশ খেয়েছিলাম সে-গল্প আমার বউয়ের কাছে করে একবার গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। মজার কথা হল, বউ সে-সব গল্প আগে থেকেই জানত। কিন্তু, অতীতকে চোখের সামনে বর্তমান করে তোলার একটা জাদু-ক্ষমতা মায়ের ছিল। ফলত পুরোনো কাসুন্দির ঝাঁঝেও বউয়ের চোখে জল (এবং গলায় ঝাল) চলে আসা খুব স্বাভাবিক। তবে, নিজের বোকামি, শারীরিক ত্রুটি, এমনকি ক‍্যানসার নিয়েও যে-ব‍্যক্তি মশকরা করতে পারে, তার ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা যায় না বোধহয়। তাই মায়ের গল্প টাইমবোমার সমধর্মী জেনেও আমার তুতো-দিদিরা যখন পঞ্চবাণাহত, তখন অসমবয়সী মায়ের সঙ্গেই অনসূয়া বা প্রিয়ংবদা পাতিয়ে হৃদয়ভার লাঘব করে গিয়েছিল।
     আজ মনে হয়, এই প্রবণতা, এই অতীতচারিতা, খুব একটা ভালো লক্ষণ নয়। কেমন যেন মনে হয়, যাদের ভবিষ‍্যতে কোনও আগ্রহ নেই, তারাই সর্বদা অতীতের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। হয়তো তারা ভাবে যে তাদের সেরা সময়টা তারা কাটিয়ে ফেলেছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ আর যেন অনুভব করে না তারা। আমার বিয়ে, চাকরি, সন্তানদের জন্ম, সংসারটা মোটামুটি দাঁড়িয়ে যাওয়া --মায়ের সামনে আর কোনও চড়ার মতো পাহাড় রাখেনি বোধহয়। মা তাই ভবিষ‍্যতের দরজা বন্ধ রেখে অতীতের খিড়কি দুয়োরে বসে থাকত সারা সকাল। বহু সংগ্রামের কালো রাত কেটে গিয়েছিল মায়ের। তাই হয়তো অলক্ষে থাকা কোনও জীবনদেবতাকে বলত, পুছো না ক‍্যায়সে ম‍্যায়নে র‍্যায়েন বিতাই।

শেষবার মায়ের সঙ্গে চা খাওয়া হল ত্রিবেণীতে। ভোরভোর পৌঁছে গিয়েছিলুম আমরা। তাও অনেকের পরে লাইন। সারারাত পেটে কিছু পড়েনি কারও। সবাই চা খেতে চলে গেল। আমি আর বাবা মাকে ছুঁয়ে বসে রইলাম। গঙ্গার ওপর লাল সূর্য উঁকি দিচ্ছে তখন। একটু পরে অঞ্জন এসে দাঁড়াল। দেখি, আমাদের জন‍্য চা এনেছে মনে করে। আমাদের তিনজনের জন‍্য।

দু'কাপ।

(চলবে)

Sunday, October 1, 2017

মায়ের কথা মনে পড়লে (২)

মায়ের কথা মনে পড়লে (২)
মুক্তিপ্রকাশ রায়

মায়ের কথা মনে পড়লে আমার নাকে আলোচালের ফেনভাত আর ঘি বা মাখনের গন্ধ আসে। না, এ-কারণে নয় যে মা চলে যাওয়ার পর আমাকে হবিষ‍্য করতে হয়েছিল কিছুদিন। আসলে ছোটোবেলায় ওই খাবারটাই মা আমাকে আর বোনকে খাইয়ে ইস্কুলে পাঠাত।
     ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র‍্যের মধ‍্যে ঐক‍্যের ধারা মেনে ভাতের সঙ্গে সহাবস্থান করত টম‍্যাটো, শীতকালে ফুলকপি, অন‍্যান‍্য ঋতুতে আলুসহ নানা সবজি। ওই খাবারের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ থাকত সোনায় সোহাগার মতো। আমরা মহা তৃপ্তির সঙ্গে সাপটে খেয়ে ইস্কুলের পথে রওনা হতুম।
     হবিষ‍্য করার সময়ও আমার মনে হত ইস্কুলেই যাচ্ছি বুঝি। মাকে ছাড়া বাঁচতে শেখা এক কঠিন শিক্ষা ছাড়া আর কী। ইস্কুলে যে-সুশীলবাবুর চোখ সারাবছরই লাল হয়ে থাকত, তাঁর চেয়েও কড়া এক শিক্ষক আমাদের জীবন। তবে যে-খাবার মা আমাদের মুখে তুলে দিত, তার গুরুত্ব বুঝতে গেলে আর এক ইন্দ্রপতনের কথা মনে করতে হবে।
     দাদুর, মানে আমার ঠাকুর্দা রবি রায়ের, তখনও রাইগর মর্টিস শুরু হয়নি, গোটা আরামবাগ ভারী চিন্তায় পড়ে গেল --'এবার এরা খাবে কী?' সত‍্য বটে। দাদু ছিল পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ব‍্যক্তি (যদিও ডাক্তার হিসেবে নামডাক থাকলেও দাদুর রোজগার কখনওই বেশি ছিল না। অন্তত সেই ডাক্তারবাবুর ধারেকাছেও নয় যিনি বাবার অ্যানজিওপ্লাস্টির জন‍্য অপারেশন থিয়েটারেই তাঁর গ্লাভস-পরা হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা করতে চাপ দিচ্ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীর দেশসেবার দুরারোগ‍্য বাতিকের সুযোগ নিয়ে পয়সাকড়ি কেউই দিত না বিশেষ। গরিবরা সত‍্যিই দিতে পারত না। অনেকে গরিব সাজত। তবু অন্নাভাব কখনও হয়নি। কিছু রোগী পয়সা দিতে পারত না, জমির ফসল নিয়ে আসত)।
     ফলে দাদু মরে গেলে হয়তো ঠাকুমার লাগানো আমগাছটা খেতে পাবে (সালোকসংশ্লেষ পড়িয়েছিলেন সুশীলবাবু), পোষা বেড়ালগুলো খেতে পাবে (ওদের পাড়াপড়শি 'ক‍্যাটক‍্যাট' করে কথা শোনালেও একটু মাছের কাঁটা বা ফেলে-দেওয়া ভাত কি আর জুটে যাবে না ওদের?), কিন্তু আমরা খাব কী?
     এ-বিষয়ে হোমরাচোমরা দু'একজন, যাঁরা দাদুর মরদেহে মাল‍্যদান করতে কলকাতার সদর পার্টিঅফিস থেকে ছুটে এসেছিলেন, এমনকী মন্ত্রীটন্ত্রী-জাতীয় প্রাণী, কোনও সমাধানসূত্র দিয়ে গেলেন না। প্রথমসারির দৈনিকে আর রেডিওয় দাদুর চলে যাওয়ার খবর সম্প্রচারের ব‍্যবস্থা করে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন। কিন্তু দাদুর ধোঁওয়ায় বিলীন শরীরটার চেয়ে বেশি সময় ধরে ত্রিবেণীর বাতাসেও ভেসে রইল ওই প্রশ্নটাই: এবার এরা খাবে কী?
     দাদু ছিলেন মহীরুহের মতো। তাঁর শাখাপ্রশাখায় আত্মীয়, অনাত্মীয়, বন্ধু, শত্রু সকলেই জায়গা পেত। তাঁর থাকাটাকে আমরা মাথার ওপর আকাশ থাকার মতোই চিরন্তন ভেবে নিয়েছিলুম। এতটাই নিশ্চিন্ত ছিলুম আমরা যে বাবা তিন-তিনবার সরকারি চাকরি পায়ে ঠেলেছিল (এটা সম্ভবত এই লাইনে একটা রেকর্ড। পরে আমরা একটু থিতু হলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করব)।
     তো দাদু মর্তধাম থেকে বিনা নোটিসে বিদায় নেওয়ায় এইরকম একটা অ্যাবসার্ড পরিস্থিতি দেখা গেল যা গল্পে লিখলে উইলিং সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ খাটবে না। বাড়িতে পাশ-করা একজন ডাক্তার থাকা সত্ত্বেও (হ‍্যাঁ, বাবাও ডাক্তার) মানুষজন বুঝে উঠতে পারছে না যে এই পরিবারের অন্নসংস্থান হবে কী করে!!!
     আমাদের আর একটা অ্যাটলাসের দরকার ছিল যে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়াটা ঠেকাতে পারে। সেই অভাব পূরণ করার মতো মনের জোর বাবার ছিল না। লোকজন মজা দেখতে জড়ো হচ্ছিল। কেউকেউ শুভানুধ‍্যায়ীর মতো জানতে চাইছিল বাড়ির জিনিসপত্র আমরা সস্তায় বিক্রি করতে রাজি আছি কি না; তাহলে তারা কিনে নিয়ে আমাদের সাহায‍্য করতে পারে। তখন মা হঠাৎ আমাদের ঘিরে নিল কোলগেটের সুরক্ষাচক্রের মতো। মা হঠাৎ বটগাছ হয়ে গেল।


ত্রিবেণীতে মায়ের গায়ে যখন ঘি মাখাতে হচ্ছিল, আমার মনে পড়ছিল আমি আর বোন কখনও না-খেয়ে ইস্কুলে যাইনি।

(চলবে)