Friday, October 6, 2017

মায়ের কথা মনে পড়লে (৩)

মায়ের কথা মনে পড়লে (৩)
মুক্তিপ্রকাশ রায়

সকালের চা-টা আমার মায়ের সঙ্গেই খাওয়া অভ‍্যেস। অন্তত কয়েকমাস আগে অবধি এই রুটিনের নড়চড় হয়নি। বউও একটু জেলাস হত কি না কে-জানে! কপট রাগ দেখিয়ে মা-ন‍্যাওটা ছেলেকে তুলে দিয়ে বলত, যাও মায়ের সঙ্গে চা খেতেখেতে আদিখ‍্যেতা করে এসো।
     সকালের চা খেতেখেতে গুনগুন করে গান গাইত মা, "পুছো না ক‍্যায়সে ম‍্যায়নে র‍্যায়েন বিতাই"। এটা নাকি আবার দিদিমার প্রিয় গান ছিল। মা কখনও তেমন প্রথাগতভাবে গান না শিখলেও বেশ সুরেই গাইত। অনেকে মায়ের গান বৈঠকি আড্ডায় শুনে বলেছে, বউদির গলা তো বেশ মিষ্টি! মা শুনে লজ্জা পেত। দিদিমার রেওয়াজি গলার কণামাত্রও নাকি মা পায়নি। মাসিমণি অনেকটা পেয়েছে। আসলে সকালে আমি যখন মায়ের পাশে বসে চা খেতাম, মা অলক্ষে গল্প করে নিত দিদিমার সঙ্গে। ওই গানটার মধ‍্যে দু'জনের দেখা হত। আমরা বাইরে থেকে কিছু বুঝতে পারতুম না।
     আজ বুঝতে পারি ওই চায়ের সঙ্গে ফেলে-আসা দিনগুলো মিশিয়ে অদ্ভুত গাঢ় এক লিকার তৈরি করত মা। তাই সবজায়গায় চা খেয়ে আমি সেরকম তৃপ্তি পাই না। চায়ের সঙ্গে 'টা'-হিসেবে কয়েকটা মুচমুচে অ্যানেকডোট আমার চাইই চাই।
     আমার গোটা সকাল জুড়ে থাকত মায়ের ছোটোবেলার গল্প, নানারকম ক‍্যাবলামোর গল্প, জেঠতুতো আর মামাতো দাদাদিদির গল্প। প্রচুর ডিটেইলস মনে রাখতে পারত মা। পরে পরীক্ষা করে দেখেছি, যাদের কেন্দ্র করে গল্প, তাদেরই বহু কথা মনে নেই। বিশেষ করে, কে কবে কার প্রেমে পড়েছিল, সেই গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলতে ভালোবাসত মা; আর গল্পের নায়ক বা নায়িকা, যাঁর এখন চুলে পাক ধরেছে, এ-হেন না-পাক গল্পকে প্রাণপণে অস্বীকার করতেন। আমাকে একান্তে এমন কথাও তাঁরা বলে গেছেন, তোর মায়ের মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে গেছে, ভালো সাইকায়াট্রিস্ট দেখা।
     আমারও বিপদ হয়নি তা নয়। আরামবাগের কোন ললনার ওপর কৈশোরে আমি কিঞ্চিৎ ক্রাশ খেয়েছিলাম সে-গল্প আমার বউয়ের কাছে করে একবার গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। মজার কথা হল, বউ সে-সব গল্প আগে থেকেই জানত। কিন্তু, অতীতকে চোখের সামনে বর্তমান করে তোলার একটা জাদু-ক্ষমতা মায়ের ছিল। ফলত পুরোনো কাসুন্দির ঝাঁঝেও বউয়ের চোখে জল (এবং গলায় ঝাল) চলে আসা খুব স্বাভাবিক। তবে, নিজের বোকামি, শারীরিক ত্রুটি, এমনকি ক‍্যানসার নিয়েও যে-ব‍্যক্তি মশকরা করতে পারে, তার ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা যায় না বোধহয়। তাই মায়ের গল্প টাইমবোমার সমধর্মী জেনেও আমার তুতো-দিদিরা যখন পঞ্চবাণাহত, তখন অসমবয়সী মায়ের সঙ্গেই অনসূয়া বা প্রিয়ংবদা পাতিয়ে হৃদয়ভার লাঘব করে গিয়েছিল।
     আজ মনে হয়, এই প্রবণতা, এই অতীতচারিতা, খুব একটা ভালো লক্ষণ নয়। কেমন যেন মনে হয়, যাদের ভবিষ‍্যতে কোনও আগ্রহ নেই, তারাই সর্বদা অতীতের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। হয়তো তারা ভাবে যে তাদের সেরা সময়টা তারা কাটিয়ে ফেলেছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ আর যেন অনুভব করে না তারা। আমার বিয়ে, চাকরি, সন্তানদের জন্ম, সংসারটা মোটামুটি দাঁড়িয়ে যাওয়া --মায়ের সামনে আর কোনও চড়ার মতো পাহাড় রাখেনি বোধহয়। মা তাই ভবিষ‍্যতের দরজা বন্ধ রেখে অতীতের খিড়কি দুয়োরে বসে থাকত সারা সকাল। বহু সংগ্রামের কালো রাত কেটে গিয়েছিল মায়ের। তাই হয়তো অলক্ষে থাকা কোনও জীবনদেবতাকে বলত, পুছো না ক‍্যায়সে ম‍্যায়নে র‍্যায়েন বিতাই।

শেষবার মায়ের সঙ্গে চা খাওয়া হল ত্রিবেণীতে। ভোরভোর পৌঁছে গিয়েছিলুম আমরা। তাও অনেকের পরে লাইন। সারারাত পেটে কিছু পড়েনি কারও। সবাই চা খেতে চলে গেল। আমি আর বাবা মাকে ছুঁয়ে বসে রইলাম। গঙ্গার ওপর লাল সূর্য উঁকি দিচ্ছে তখন। একটু পরে অঞ্জন এসে দাঁড়াল। দেখি, আমাদের জন‍্য চা এনেছে মনে করে। আমাদের তিনজনের জন‍্য।

দু'কাপ।

(চলবে)

No comments: