মায়ের কথা মনে পড়লে (২)
মুক্তিপ্রকাশ রায়
মায়ের কথা মনে পড়লে আমার নাকে আলোচালের ফেনভাত আর ঘি বা মাখনের গন্ধ আসে। না, এ-কারণে নয় যে মা চলে যাওয়ার পর আমাকে হবিষ্য করতে হয়েছিল কিছুদিন। আসলে ছোটোবেলায় ওই খাবারটাই মা আমাকে আর বোনকে খাইয়ে ইস্কুলে পাঠাত।
ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারা মেনে ভাতের সঙ্গে সহাবস্থান করত টম্যাটো, শীতকালে ফুলকপি, অন্যান্য ঋতুতে আলুসহ নানা সবজি। ওই খাবারের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ থাকত সোনায় সোহাগার মতো। আমরা মহা তৃপ্তির সঙ্গে সাপটে খেয়ে ইস্কুলের পথে রওনা হতুম।
হবিষ্য করার সময়ও আমার মনে হত ইস্কুলেই যাচ্ছি বুঝি। মাকে ছাড়া বাঁচতে শেখা এক কঠিন শিক্ষা ছাড়া আর কী। ইস্কুলে যে-সুশীলবাবুর চোখ সারাবছরই লাল হয়ে থাকত, তাঁর চেয়েও কড়া এক শিক্ষক আমাদের জীবন। তবে যে-খাবার মা আমাদের মুখে তুলে দিত, তার গুরুত্ব বুঝতে গেলে আর এক ইন্দ্রপতনের কথা মনে করতে হবে।
দাদুর, মানে আমার ঠাকুর্দা রবি রায়ের, তখনও রাইগর মর্টিস শুরু হয়নি, গোটা আরামবাগ ভারী চিন্তায় পড়ে গেল --'এবার এরা খাবে কী?' সত্য বটে। দাদু ছিল পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি (যদিও ডাক্তার হিসেবে নামডাক থাকলেও দাদুর রোজগার কখনওই বেশি ছিল না। অন্তত সেই ডাক্তারবাবুর ধারেকাছেও নয় যিনি বাবার অ্যানজিওপ্লাস্টির জন্য অপারেশন থিয়েটারেই তাঁর গ্লাভস-পরা হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা করতে চাপ দিচ্ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীর দেশসেবার দুরারোগ্য বাতিকের সুযোগ নিয়ে পয়সাকড়ি কেউই দিত না বিশেষ। গরিবরা সত্যিই দিতে পারত না। অনেকে গরিব সাজত। তবু অন্নাভাব কখনও হয়নি। কিছু রোগী পয়সা দিতে পারত না, জমির ফসল নিয়ে আসত)।
ফলে দাদু মরে গেলে হয়তো ঠাকুমার লাগানো আমগাছটা খেতে পাবে (সালোকসংশ্লেষ পড়িয়েছিলেন সুশীলবাবু), পোষা বেড়ালগুলো খেতে পাবে (ওদের পাড়াপড়শি 'ক্যাটক্যাট' করে কথা শোনালেও একটু মাছের কাঁটা বা ফেলে-দেওয়া ভাত কি আর জুটে যাবে না ওদের?), কিন্তু আমরা খাব কী?
এ-বিষয়ে হোমরাচোমরা দু'একজন, যাঁরা দাদুর মরদেহে মাল্যদান করতে কলকাতার সদর পার্টিঅফিস থেকে ছুটে এসেছিলেন, এমনকী মন্ত্রীটন্ত্রী-জাতীয় প্রাণী, কোনও সমাধানসূত্র দিয়ে গেলেন না। প্রথমসারির দৈনিকে আর রেডিওয় দাদুর চলে যাওয়ার খবর সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন। কিন্তু দাদুর ধোঁওয়ায় বিলীন শরীরটার চেয়ে বেশি সময় ধরে ত্রিবেণীর বাতাসেও ভেসে রইল ওই প্রশ্নটাই: এবার এরা খাবে কী?
দাদু ছিলেন মহীরুহের মতো। তাঁর শাখাপ্রশাখায় আত্মীয়, অনাত্মীয়, বন্ধু, শত্রু সকলেই জায়গা পেত। তাঁর থাকাটাকে আমরা মাথার ওপর আকাশ থাকার মতোই চিরন্তন ভেবে নিয়েছিলুম। এতটাই নিশ্চিন্ত ছিলুম আমরা যে বাবা তিন-তিনবার সরকারি চাকরি পায়ে ঠেলেছিল (এটা সম্ভবত এই লাইনে একটা রেকর্ড। পরে আমরা একটু থিতু হলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করব)।
তো দাদু মর্তধাম থেকে বিনা নোটিসে বিদায় নেওয়ায় এইরকম একটা অ্যাবসার্ড পরিস্থিতি দেখা গেল যা গল্পে লিখলে উইলিং সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ খাটবে না। বাড়িতে পাশ-করা একজন ডাক্তার থাকা সত্ত্বেও (হ্যাঁ, বাবাও ডাক্তার) মানুষজন বুঝে উঠতে পারছে না যে এই পরিবারের অন্নসংস্থান হবে কী করে!!!
আমাদের আর একটা অ্যাটলাসের দরকার ছিল যে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়াটা ঠেকাতে পারে। সেই অভাব পূরণ করার মতো মনের জোর বাবার ছিল না। লোকজন মজা দেখতে জড়ো হচ্ছিল। কেউকেউ শুভানুধ্যায়ীর মতো জানতে চাইছিল বাড়ির জিনিসপত্র আমরা সস্তায় বিক্রি করতে রাজি আছি কি না; তাহলে তারা কিনে নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারে। তখন মা হঠাৎ আমাদের ঘিরে নিল কোলগেটের সুরক্ষাচক্রের মতো। মা হঠাৎ বটগাছ হয়ে গেল।
ত্রিবেণীতে মায়ের গায়ে যখন ঘি মাখাতে হচ্ছিল, আমার মনে পড়ছিল আমি আর বোন কখনও না-খেয়ে ইস্কুলে যাইনি।
(চলবে)
মুক্তিপ্রকাশ রায়
মায়ের কথা মনে পড়লে আমার নাকে আলোচালের ফেনভাত আর ঘি বা মাখনের গন্ধ আসে। না, এ-কারণে নয় যে মা চলে যাওয়ার পর আমাকে হবিষ্য করতে হয়েছিল কিছুদিন। আসলে ছোটোবেলায় ওই খাবারটাই মা আমাকে আর বোনকে খাইয়ে ইস্কুলে পাঠাত।
ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারা মেনে ভাতের সঙ্গে সহাবস্থান করত টম্যাটো, শীতকালে ফুলকপি, অন্যান্য ঋতুতে আলুসহ নানা সবজি। ওই খাবারের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ থাকত সোনায় সোহাগার মতো। আমরা মহা তৃপ্তির সঙ্গে সাপটে খেয়ে ইস্কুলের পথে রওনা হতুম।
হবিষ্য করার সময়ও আমার মনে হত ইস্কুলেই যাচ্ছি বুঝি। মাকে ছাড়া বাঁচতে শেখা এক কঠিন শিক্ষা ছাড়া আর কী। ইস্কুলে যে-সুশীলবাবুর চোখ সারাবছরই লাল হয়ে থাকত, তাঁর চেয়েও কড়া এক শিক্ষক আমাদের জীবন। তবে যে-খাবার মা আমাদের মুখে তুলে দিত, তার গুরুত্ব বুঝতে গেলে আর এক ইন্দ্রপতনের কথা মনে করতে হবে।
দাদুর, মানে আমার ঠাকুর্দা রবি রায়ের, তখনও রাইগর মর্টিস শুরু হয়নি, গোটা আরামবাগ ভারী চিন্তায় পড়ে গেল --'এবার এরা খাবে কী?' সত্য বটে। দাদু ছিল পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি (যদিও ডাক্তার হিসেবে নামডাক থাকলেও দাদুর রোজগার কখনওই বেশি ছিল না। অন্তত সেই ডাক্তারবাবুর ধারেকাছেও নয় যিনি বাবার অ্যানজিওপ্লাস্টির জন্য অপারেশন থিয়েটারেই তাঁর গ্লাভস-পরা হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা করতে চাপ দিচ্ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীর দেশসেবার দুরারোগ্য বাতিকের সুযোগ নিয়ে পয়সাকড়ি কেউই দিত না বিশেষ। গরিবরা সত্যিই দিতে পারত না। অনেকে গরিব সাজত। তবু অন্নাভাব কখনও হয়নি। কিছু রোগী পয়সা দিতে পারত না, জমির ফসল নিয়ে আসত)।
ফলে দাদু মরে গেলে হয়তো ঠাকুমার লাগানো আমগাছটা খেতে পাবে (সালোকসংশ্লেষ পড়িয়েছিলেন সুশীলবাবু), পোষা বেড়ালগুলো খেতে পাবে (ওদের পাড়াপড়শি 'ক্যাটক্যাট' করে কথা শোনালেও একটু মাছের কাঁটা বা ফেলে-দেওয়া ভাত কি আর জুটে যাবে না ওদের?), কিন্তু আমরা খাব কী?
এ-বিষয়ে হোমরাচোমরা দু'একজন, যাঁরা দাদুর মরদেহে মাল্যদান করতে কলকাতার সদর পার্টিঅফিস থেকে ছুটে এসেছিলেন, এমনকী মন্ত্রীটন্ত্রী-জাতীয় প্রাণী, কোনও সমাধানসূত্র দিয়ে গেলেন না। প্রথমসারির দৈনিকে আর রেডিওয় দাদুর চলে যাওয়ার খবর সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন। কিন্তু দাদুর ধোঁওয়ায় বিলীন শরীরটার চেয়ে বেশি সময় ধরে ত্রিবেণীর বাতাসেও ভেসে রইল ওই প্রশ্নটাই: এবার এরা খাবে কী?
দাদু ছিলেন মহীরুহের মতো। তাঁর শাখাপ্রশাখায় আত্মীয়, অনাত্মীয়, বন্ধু, শত্রু সকলেই জায়গা পেত। তাঁর থাকাটাকে আমরা মাথার ওপর আকাশ থাকার মতোই চিরন্তন ভেবে নিয়েছিলুম। এতটাই নিশ্চিন্ত ছিলুম আমরা যে বাবা তিন-তিনবার সরকারি চাকরি পায়ে ঠেলেছিল (এটা সম্ভবত এই লাইনে একটা রেকর্ড। পরে আমরা একটু থিতু হলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করব)।
তো দাদু মর্তধাম থেকে বিনা নোটিসে বিদায় নেওয়ায় এইরকম একটা অ্যাবসার্ড পরিস্থিতি দেখা গেল যা গল্পে লিখলে উইলিং সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ খাটবে না। বাড়িতে পাশ-করা একজন ডাক্তার থাকা সত্ত্বেও (হ্যাঁ, বাবাও ডাক্তার) মানুষজন বুঝে উঠতে পারছে না যে এই পরিবারের অন্নসংস্থান হবে কী করে!!!
আমাদের আর একটা অ্যাটলাসের দরকার ছিল যে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়াটা ঠেকাতে পারে। সেই অভাব পূরণ করার মতো মনের জোর বাবার ছিল না। লোকজন মজা দেখতে জড়ো হচ্ছিল। কেউকেউ শুভানুধ্যায়ীর মতো জানতে চাইছিল বাড়ির জিনিসপত্র আমরা সস্তায় বিক্রি করতে রাজি আছি কি না; তাহলে তারা কিনে নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারে। তখন মা হঠাৎ আমাদের ঘিরে নিল কোলগেটের সুরক্ষাচক্রের মতো। মা হঠাৎ বটগাছ হয়ে গেল।
ত্রিবেণীতে মায়ের গায়ে যখন ঘি মাখাতে হচ্ছিল, আমার মনে পড়ছিল আমি আর বোন কখনও না-খেয়ে ইস্কুলে যাইনি।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment