Thursday, September 28, 2017

মায়ের কথা মনে পড়লে

মায়ের কথা মনে পড়লে
মুক্তিপ্রকাশ রায়

মায়ের কথা ভাবলেই আমার নাকে এ.ডি. অয়েলের গন্ধ আসে। ছোটোবেলায় শীতের রোদে ওই তেলটা মাখিয়ে আমায় শুইয়ে দিত মা। আজও এ.ডি. অয়েলের বোতল খুললে আরব‍্য রজনীর দৈত‍্যের মতো হুউশ করে বেরিয়ে আসে মনকেমনের একঝলক লিলুয়া বাতাস। অবচেতনের বাগদাদ শহরে হারুন-অল-রশিদের মতো ছোটোবেলাকে খুঁজে ফিরি আমি।
      পথে নামলে বোঝা যায় যে ছোটোবেলার সবকিছু টেডি বিয়ারের মতো তুলতুলে নয়। ভাঙা কাচের টুকরোয় হাত-পা কেটে রক্তারক্তির সম্ভাবনা প্রবল। অজান্তে নিজের ঠোঁটে হাত বুলোই একবার। ঠোনা মেরে একবার ঠোঁট ফাটিয়ে দিয়েছিল মা।
      তখন বাড়ির সামনের মাঠ থেকে ধুলো, কাদা মেখে বাড়ি ফিরতাম আমি। অপসংস্কৃতির কিছু অবাঞ্ছিত দাগও লেগে যেত গায়ে। বাড়ির কারও সে-সব পছন্দ ছিল না। হাজার হোক, সংস্কৃতি একটা অভ‍্যাসের ব‍্যাপার। বর্ণাশ্রমেরও। যে কর্নফ্লেক্স খেতে অভ‍্যস্ত, তার কাছে মুড়ি চিবোনো একটা আনকালচার্ড ব‍্যাপার। বাড়ির লোক 'ব্লাডি সোয়াইন' বা 'ব্লাডি বাস্টার্ড' কর্ণসহ মনে করলেও 'বেজন্মার বাচ্চা'-জাতীয় শব্দবন্ধকে ইতর বা 'আদার' জ্ঞানে পরিহার করে চলতেন। এর মধ‍্যে বাড়ির সামনের মাঠে আমি খেলার পরিসরে বর্ণাশ্রমের 'গেঁড়ো তুলতে' শুরু করেছিলাম। বিবেকানন্দের কতটা সুযোগ ঘটেছিল জানি না, কিন্তু আমি মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, মুচি, মেথর সকলকেই খেলার সঙ্গী হিসেবে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলাম। তো, তাদের কাছ থেকে একটা নতুন শব্দাস্ত্র আয়ত্ত করা গেল --'খানকির ছেলে'। ছোটোবেলা থেকেই আমি পারফেকশনিস্ট। যে-কোনও শিক্ষা বহু অনুশীলনে নিখুঁত করে তোলার চেষ্টা আমার বরাবরের। আঁকার ক্লাসে খরগোশ আঁকা শিখে আমি বাড়ির মেঝে, দেওয়াল সব খরগোশময় করে তুলেছিলাম। বসতবাটীর এই আলতামিরাকরণে কোনও তিরস্কার তো জোটেইনি, বরং কিছু তারিফ পেয়েছিলাম বলেই মনে পড়ে। এই হাততালির লোভই (যা এখনও পূর্ণমাত্রায় বিদ‍্যমান) আমার কাল হল।
     বাড়ির উঠোনে যখন সঠিক মডিউলেশন-সহযোগে 'খানকির ছেলে' বলা অভ‍্যাস করছি, তখনই মায়ের মনোযোগ আকৃষ্ট হল: কী বলছিস?
আমি অলোকসামান‍্য সারল‍্যে কথাটা রিপিট করলুম। তখনই মায়ের হাত নেমেসিসের মতো উঠে এল। আমার ঠোঁট ভিজে উঠল রক্তে।
     আজও তাই গালাগাল দেওয়ার সময় মায়ের কথা মনে পড়লেই অভ‍্যাসগত প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় ঠোঁট চিনচিন করে আমার। ঠোঁটে একবার হাত বুলিয়ে মুছে নিতে হয় ছোটোবেলার ফোঁটাফোঁটা দাগ।

(চলবে)

No comments: