Saturday, December 23, 2017

দুলাল বিশ্বাস: zরা হটকে

দুলাল বিশ্বাস: zরা হটকে
মুক্তিপ্রকাশ রায়

মাঝেমাঝে এক-একজনের অবয়ব ছেয়ে ফ‍্যালে গোটা একটা দিন। সেদিন তার কথাই ভেসে বেড়ায় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। দেবলের বাবার কথা আজ কিছুতেই মন থেকে সরানো যাচ্ছে না। আজ তাঁর শ্রাদ্ধ।
     দেবলের বাবা দুলাল বিশ্বাস। শেষদিকটায় ভুগছিলেন খুব। ডায়ালিসিস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তবে দেবলদের লড়াইটা হঠাৎ এইভাবে শেষ হয়ে যাবে, তা ভাবেনি কেউ। দুর্বল শরীরে নিজে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন কাকু। মাথায় আঘাত ... তাতেই।
     চিরকাল আমার অদ্ভুত মানুষ পছন্দ। যাঁরা "zরা হটকে"। সাধারণ লোকের জীবন, সমারসেট মম যেমন বলেছিলেন --- ট্রামগাড়ির চলন। বাঁধা পথের বাইরে গেলে তাদের নার্ভাস ডায়েরিয়া হয়। অদ্ভুত মানুষেরা এইজন‍্যই চোখে পড়ে। মনে থেকে যায়। আলাদা হয়ে উঠতে অসম্ভব মনের জোরও থাকতে হয় বোধহয়। কাকুর কথা মনে পড়ছে গাড়িতে যেতে যেতে। ব‍্যাবসায় রোজগার যেমন করেছেন, খরচও করেছেন হাত খুলে। খরচটা মূলত খাওয়াদাওয়ায়। গর্ব করে বলতেন, বুzলা মুক্তি, দুলাল বিশ্বাস যদি না খেয়ে টাকা zমাইত, তাইলে সোনার ইট দিয়া বাড়ি বানাইত।
     খুব একটা বাড়িয়ে বলা নয়। প্রথম যেদিন খবর না দিয়ে উটকো অতিথির মতো দেবলের সঙ্গে ওদের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম, সেদিন নিতান্ত 'সাধারণ রান্না' বলতে তিনরকম মাছ আর দেশি মুরগির মাংস! তখন হস্টেলের বুভুক্ষু আমরা। বনগাঁ লোকালের গণলাঞ্ছনার গ্লানি চিতলের কাছে নিতান্ত 'পেটি' হয়ে গেল‌।
     কাকু মছলন্দপুরের বাজারে এলে লোকজন আর ভালো মাছ কিনতে পেত না। কেউ হয়তো পাঁচশো টাকার মাছকে দরাদরি করে সাড়ে চারশোয় প্রায় ম‍্যানেজ করে এনেছে, এমন সময় মার্কেটে দুলাল বিশ্বাসের আবির্ভাব। আড়চোখে তাঁকে দেখতে পেয়েই মাছের ওপর গামছা চাপা দিয়ে সরিয়ে ফেলত মাছওয়ালা-- আপনি ছেড়ে দ‍্যান, এ-মাছ বিককিরি হয়ে গেছে।
সে জানে মাছ ভালো হলে দুলাল বিশ্বাস দরাদরি করে না। কাজেই ...
     মাছওয়ালা অবশ‍্য জানত -- দুলাল বিশ্বাস কঠিন জিনিস। বাজার করায় পিএইচডি। আলতুফালতু মাল তাঁকে গছানো অসম্ভব। মাছের পেট টিপে তার ইউএসজি করে ফেলার ক্ষমতা ছিল তাঁর। এছাড়া কোন ঋতুতে কোন মাছ খেতে নেই, বেগুনের টেস্ট কোন সময়ে বাড়ে, ফুলকপি হাইব্রিড কি না -- তা কী দেখে বোঝা সম্ভব, এ-সব 'গুরুত্বপূর্ণ' বিষয়ে দুলাল বিশ্বাসের মতামত খনা-র বচনের মতোই শিরোধার্য।
     একবার লিচু পাঠানো হবে দেবলের পিসিমার বাড়িতে। এক-আধকিলো নয়, এক রিকশ-ভ‍্যান ভরা লিচু। লিচু ছোটো বলে কাকুর না-পসন্দ্। এত ছোটো লিচু কি বোনের বাড়ি পাঠানো যায়? মান যাবে না? ছেলেমেয়েদের বললেন, এগুলো তোরাই খেয়ে ফ‍্যাল।
বাড়ির ছেলেমেয়ে, সঙ্গে কাজের লোকজন, এক রিকশ-ভ‍্যান লিচু সাবড়ে দিলে! পিসিমার বাড়ির জন‍্যে আবার 'বড়ো' লিচুর অর্ডার হল।
     দেবল বোধহয় ওর গোঁয়ার্তুমি কাকুর থেকেই বংশগতির অনিবার্যতায় পেয়েছিল। দেবলই প্রথম আমায় দেখিয়েছিল -- নিজের খারাপ-লাগা কারও মুখের ওপর বলে দেওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে কাকুর একটা গল্প। একবার, সম্ভবত বনগাঁ লোকালেই, এক কমলালেবুওয়ালা কাকুর সঙ্গে তর্ক জুড়েছিল -- লেবু খেয়ে দেখুন, মিষ্টি না হলে জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেবেন। তো, কাকু নিলেন একখানা লেবু, ধীরেসুস্থে খোসা ছাড়ালেন, মুখে দিলেন এককোয়া, তারপর বাকি লেবুটা ছুড়ে ফেলে দিলেন ট্রেনের জানলা দিয়ে।
     কেন জানি না, কাকু খুব ভালোবেসে ফেলেছিলেন আমাকে। যতবার মছলন্দপুরে গেছি, বা পরে কেষ্টপুরে, উনি আমাকে খাওয়াবেন বলে বাজার করতে ব‍্যস্ত হয়ে পড়তেন। আমার ঠাকুমা ছিলেন পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু। বাঙাল-রক্ত আমার শরীরে যেটুকু আছে, তা সম্ভবত জিব আর পাকস্থলীতেই। ফলে বাঙাল রান্নার প্রতি আমার বিশেষ পক্ষপাত। আর কাকিমা, অর্থাৎ দেবলের মা, বাঙাল পদাবলির ভানুসিংহী। তাই দেবলের বাড়ি গেলেই আমার নোলা সকসক করত। মুক্তির জন‍্য 'কসুর লতি' জোগাড় না করতে পারলে কাকু ভাবতেন আতিথেয়তায় নিতান্ত ত্রুটি রয়ে গেল।
     একবার একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময় গাড়িতে উঠে পড়েছি; কাকু অন‍্যান‍্য অতিথিদের নিয়ে ব‍্যস্ত দেখে তাঁকে আর বিরক্ত না করে, কাকিমা আর দেবলের থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি; হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে কাকু এসে হাত রাখলেন আমার জানলায় -- চলে যাচ্ছ? মুক্তি, তুমি আমায় একবার বলে গেলা না?
ভেজা গলায় কথাটা যেভাবে বললেন কাকু, তার তীব্রতার কোনও তুলনা হয় না। লজ্জায় আমি তখন প্রায় সিটের নীচে ঢুকে পড়তে চাইছি, নেহাত ভুঁড়ির জন‍্যে পেরে উঠছি না।
     কাকুর চলে যাওয়ার খবর হঠাৎ পেয়ে আমারও যে একটু অভিমান হয়নি তা নয়। কোমায় চলে গেছেন শুনে দেখতে গিয়েছিলুম। সে-দেখা দুঃস্বপ্নের মতো। কাকু চোখ মেলতে পারেননি।

একবার বলে গেলেন না, কাকু?

#মুক্তিপ্রকাশরায়

No comments: